ঢালিউডে সিনেমার খরা ছিল বেশ কয়েকটি বছর। তবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের দিকে নতুন উদ্যোমে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় ঢালিউড। সিনেমা মুক্তির সংখ্যা কম থাকলেও নির্মাণের সংখ্যা বেড়েছিল ওই বছরগুলোতে। পুরোনো তারকাদের সঙ্গে নতুন অনেকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। শুধু তাই নয়, ঢাকাই সিনেমায় উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগতে শুরু করে সেসময়। বলা যায়, ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন বীজ বোনা শুরু হয়, যার ফলের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার অপেক্ষা ছিল ২০২০ সাল।
২০২০ সালের বছরের শুরুটা ভালোই ছিল। কিন্তু বাধ সাধে মহামারি করোনাভাইরাস। কয়েকটি বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তির পরও শেষ পর্যন্ত নামিয়ে নিতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল কাজী হায়াৎ পরিচালিত শাকিব খান অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘বীর’ । নির্মাণের ঘোষণার পর থেকেই তুমুল আলোচনায় ছিল এই সিনেমাটি। কিন্তু বিগ বাজেটের এই সিনেমা মুক্তির কয়েক সপ্তাহ পরেই আসে লকডাউনের ঘোষণা।
শুধু সিনেমা নয়, লকডাউনের কারণে সেসময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের সকল সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। এমন অবস্থার পর গত বছরটা খুব একটা ভালো না গেলেও ২০২১ এর শুরুর দিকে নতুন সম্ভাবনা দেখে ঢালিউড। কিন্তু আবারও মহামারির হানা। তবে এবারের চিত্রটা পাল্টে দেয় ৩ জুন কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিশিয়াল সিলেকশনে বাংলাদেশের সিনেমা ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ নির্বাচিত হওয়ার পর।
আরও পড়ুন: মেহজাবীন-রাজীবের প্রেমের গুঞ্জন সত্যি হলো!
বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই চলচ্চিত্র উৎসবে ঢালিউডের অংশগ্রহণ ইন্ডাস্ট্রিকে নতুন এক মোড়ে নিয়ে আসে। দেশের গণমাধ্যম থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অনেক গণমাধ্যমের চোখ তখন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর দিকে। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। নাম ভূমিকায় অভিনয় করে দীর্ঘদিন পর আলোচনায় এসেছেন অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন।
‘রেহেনা মরিয়ম নূর’ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও তখন পর্যন্ত দেশের অন্য সিনেমাগুলোর জন্য সময়টা ছিল প্রেক্ষাগৃহ খোলার অপেক্ষা। যার অবসান হয় অক্টোবরে। এতদিন পর হল খোলার পর সংশ্লিষ্ট সবার মুখে হাসি ফুটেছিল। একই মাসে মুক্তি পায় আলোচিত তিন সিনেমা। সেগুলো হলো- পদ্মপূরাণ, চন্দ্রাবতীর কথা ও ঢাকা ড্রিম।
চলতি বছরের সিনেমার ব্যবসা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যৈষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা তো গত বছর থেকেই খুব ভালো অবস্থায় নেই। তবে এই বছর অনেকটাই ভালো অবস্থার মধ্য দিয়ে কেটেছে। দর্শকরাও হলমুখি হয়েছে। যে কয়টি সিনেমা আমাদের সিনেপ্লেক্সে চলেছে সেগুলো স্বাভাবিক দর্শক ছিল। আসলে করোনার সঙ্গে গত বছর মোকাবিলার অভিজ্ঞতা ছিল নতুন। তাই হলে আশা নিয়েও বেশিরভাগ দর্শকের মধ্যে দ্বিধা কাজ করেছে। তবে এবারের চিত্রটা ভিন্ন। মাঝে হল বন্ধ থাকার পর যখন আবারও খোলা ঘোষণা এলো, শুরুতেই বেশ কয়েকটি বাংলা সিনেমা মুক্তি পায়। এটি অবশ্যই ইন্ডাস্ট্রির জন্য বেশ ইতিবাচক দিক। আর সবগুলো সিনেমাই ছিল আলোচিত। ব্যবসায়িক জায়গা থেকে আমরা সন্তুষ্ট। আগামী বছর আরও কয়েকটি বড় বাজেটের সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় আছে।’
আরও পড়ুন: স্টার সিনেপ্লেক্সে মুক্তি পেল ‘স্পাইডার ম্যান: নো ওয়ে হোম’
নভেম্বর মাসও ছিল ঢালিউডের আলোচনার মাস। যার কেন্দ্রবিন্দু ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। কান চলচ্চিত্র উৎসব জয় করা আসা সিনেমাটি মুক্তি পায় ১২ নভেম্বর। যা এদেশের দর্শকদেরও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রথমবার প্রকাশ্যে এসেছিলেন পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বাঁধনসহ তার টিম নিয়ে প্রচারণাও চালিয়েছেন সাদ।
৩ ডিসেম্বর মুক্তি পায় এ বছরের বিগ বাজেটের সিনেমা ‘মিশন এক্সট্রিম’। দেশের বাইরেও একই দিনে মুক্তি দেয়া হয় সিনেমাটি। সাড়াও মিলেছে বেশ ভালো। সানি সানোয়ার পরিচালিত এই সিনেমা দিয়ে দীর্ঘদিন পর পর্দায় দেখা দিলেন আরিফিন শুভ। এবার তার সঙ্গে জুটি বাঁধেন সাবেক ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী।
এত আশার মাঝে খানিকটা হতাশার কথা ব্যক্ত করলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও মধুমিতা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ।
তিনি বলেন, ‘সিনেমার সোনালী সময় আমরা দেখে এসেছি। আর এখন কী অবস্থা দেখছি! সারা দেশে ভালো মানের হলের সংখ্যা একশও নেই। যার কারণ ভালো মানের সিনেমার অভাব। এখন সেগুলো দিয়ে ব্যবসা হয় না। আমরা বলেছিলাম এদেশে বিদেশি সিনেমার বাজার খুলে দেয়া হোক। আমরা চাই কলকাতার ও হিন্দি সিনেমার বাজার এখানে গড়ে উঠুক। এতে যেমন ব্যবসা হবে তেমনি প্রতিযোগিতাও বাড়বে। এখন সাফটা (সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া) চুক্তির মাধ্যমে এই সুবিধা পাওয়া গেলেও সেটিতে উপকার হচ্ছে না। একটি হিন্দি সিনেমা ভারতে যেদিন মুক্তি দেয়া হবে সেদিন আমাদের দেশেও দিতে হবে। তাহলে আসল ব্যবসাটা হবে।’
সরকার থেকে হল সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাড়ছে না হলের সংখ্যা। এই প্রসঙ্গে ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ আরও বলেন, ‘হল সংস্কারের জন্য লোন বরাদ্দ হয়েছে এটি খুবই আনন্দের খবর আমাদের জন্য। এর জন্য সরকারকেও সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সমস্যা হলো ব্যবসা করার মতো সিনেমাই তো নির্মাণ হচ্ছে না। তাহলে একজন হল মালিক লোন নিয়ে সেটা ফেরত দেবেন কীভাবে! মাল্টিপ্লেক্সের সময় এখন। বাজারের টিকে থাকতে হলে সেভাবেই সবাইকে গড়তে হবে। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন ব্যবসায়িক উন্নতি। এর জন্য দেশের সিনেমারও উন্নতি প্রয়োজন।’
অন্যদিকে দেশের সিনেমার উন্নতি বা সিনেমা হলের সংকট নিয়ে যে সমস্যা, সেটি দীর্ঘদিন থাকবে না বলে মনে করেন এ বছরেরর আলোচিত সিনেমা ‘পদ্মপুরাণ’-এর পরিচালক রাশিদ পলাশ।
আরও পড়ুন: মিস ইউনিভার্স ২০২১: কে এই হারনাজ সান্ধু
তিনি বলেন, ‘দর্শক এখন ভালো পরিবেশে সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছেন। সিঙ্গেল স্ক্রিনের হলগুলোর অবস্থা ভালো নয়। সেগুলোর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। মাল্টিপ্লেক্সগুলোয় কিন্তু দর্শক আসছে। এখন যেহেতু মাল্টিপ্লেক্সের সংখ্যা কম তাই ব্যবসার অগ্রগতিও কম। কিন্তু আমি আশাবাদী। কারণ এখন মাল্টিপ্লেক্স বাড়ছে। আগামীতে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। আমরা নতুন এক সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যার বীজটা এখন বোনা হচ্ছে। ফল পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
এ বছর এখনও দুটি সিনেমার মুক্তি বাকি রয়েছে। যার মধ্যে নির্মাতা রনি ভৌমিকের পরিচালনায় ‘মৃধা বনাম মৃধা’ মুক্তি পাবে ২৪ ডিসেম্বর। যেখানে প্রথমবার জুটি বেঁধেছেন সিয়াম আহমেদ ও নোভা ফিরোজ। এছাড়াও ৩১ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে মীর সাব্বির পরিচালিত ‘রাত জাগা ফুল’। সরকারি অনুদানের এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন আবু হুরায়রা তানভীর, জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী, মীর সাব্বির প্রমুখ। বছরের শেষ দুটি সিনেমা নিয়েও আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। এখন অপেক্ষা মুক্তির।